মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ০৩:৫৭ অপরাহ্ন

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও দেশের কৃষি

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও দেশের কৃষি

খালিদ ফেরদৌস :
বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিকসহ বিভিন্ন সূচকে এগিয়ে যাচ্ছে, এ কথা বর্তমান সরকারের ঘোর বিরোধীরাও অপকটে স্বীকার করে থাকেন। আবার সামাজিক ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের পরিবেশের ক্ষেত্রে সূচকে ‘ছন্দহীনতা’ সরকারদলীয় লোকজন ও অনেক নীতিনির্ধারকও স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। আমাদের প্রাণসঞ্চারের কৃষিখাতও উন্নয়নের মহাসড়কে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কৃষিপণ্যের দাম ও বাজার উন্নয়নে চোখে পড়ার মতো কোনো অগ্রগতি হয়নি খাতটিতে।

জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম এক মণ ধানে এক কেজি গরুর গোশত। এমন সংবাদ প্রকাশের পর বিষয়টি চার পাশে ঘূর্ণিঝড় ‘ফণি’র মতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। কৃষক উৎপাদিত পণ্যের বাজারমূল্য এখন অবিশ্বাস্য রকমের কম। অথচ দেশ কৃষকদের হাড়ভাঙা খাটুনি ও গায়ের ঘামে গা ভেজানো পরিশ্রমে এগিয়ে চলেছে। ছোট্ট বাংলাদেশ ১৭ কোটি বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশ হওয়া সত্ত্বেও খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ দেশ এখন সারা পৃথিবীতে মাছ উৎপাদনে চতুর্থ। ধান, পাট, শাকসবজি উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয় দেশের কাতারে। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ২০০ দেশের মধ্যে ৪২তম অর্থনীতির দেশ। জিডিপির প্রবৃদ্ধি এ বছর যদি হয় ৮ শতাংশ, তা হবে বিশ্বে তৃতীয় সেরা। উন্নতির গতি আরো বেগবান করতে পারলে একদিন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে চীন ও ভারতকেও ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশ। তাই অনেকের প্রশ্ন, এমন দুর্বার অগ্রগতির মাঝে কৃষকদের এত দুরবস্থা কেন?

কৃষকদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, নিজের জমিতে ধান চাষ করলে বিঘাপ্রতি খরচ প্রায় ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা। অন্যের জমি ইজারা নিয়ে ধান চাষ করলে বিঘাপ্রতি খরচ হয় ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা। এটা ন্যূনতম খরচ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্র্ধ্বগতির বাস্তবতায় এর চেয়ে কম খরচে ধান চাষ করা অসম্ভব। ধান রোপণের জন্য চারা উৎপাদন করতে হয় বা চারা কিনতে হয়। এর জন্য বিঘাপ্রতি এক হাজার টাকার মতো লাগে। এরপর জমি প্রস্তুতির জন্য লাগে এক হাজার ৫০০ টাকা, রোপণ করতে এক হাজার ৫০০ টাকা। সার-কীটনাশক বাবদ খরচ দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার টাকার মতো। সেচের জন্য এক হাজার ৬০০ টাকা, আগাছা দমনে লাগে এক হাজার টাকা। ধান পাকলে কাটার জন্য ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিঘাপ্রতি খরচ তিন হাজার টাকা। কাটা ধান বাড়িতে আনতে পরিবহন খরচ এক হাজার টাকা। ধান মাড়াই করতে এক হাজার ৫০০ টাকা। এটা হলো নিজ জমিতে বিঘাপ্রতি ধান উৎপাদন খরচ। জমি লিজ নিয়ে ধান চাষে বিঘাপ্রতি খরচ হয় আরো ছয় হাজার টাকা বেশি। এ দেশে সাধারণত বিঘাপ্রতি ধানের উৎপাদন গড়ে ২০ থেকে ২৫ মণ। বর্তমান বাজারে এক মণ ধানের দাম ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা। অনেক এলাকায় আরো কম। জমি নিজের হলে এবং ফলন গ্রহণযোগ্য পরিমাণে হলে ধান চাষে বিঘাপ্রতি ক্ষতি হয় দুই হাজার থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকার মতো। আর লিজ নিয়ে চাষ করলে ক্ষতি হয় চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। এর অর্থ দাঁড়ায়, ধানের ফলন বাম্পার হলেও কৃষক লোকসানের শিকার। আর মাঝের তিন মাসের অক্লান্ত পরিশ্রম, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কোনো মূল্যায়ন নেই। আর এবার ধান কাটার ভরা মওসুমে ঝড়-বৃষ্টি; অনেক কৃষক সময় মতো ফসল ঘরে তুলতে পারেননি। তারপরও কৃষক ধান চাষ করবেন। এ ছাড়া তাদের কোনো গতি নেই। ধান বিক্রি করতে না পারলে রেখে দেয়া যায় কিংবা বাঙালির প্রধান খাদ্য হওয়াতে তা খাওয়া যায়। কিন্তু সে সব কৃষিপণ্য পচনশীল, তা রাখা যায় না; যেমন শাকসবজি, ফলমূল। যশোর, ঝিনাইদহ, রংপুর অঞ্চলে রবি বা শীত মওসুমে অনেক শাকসবজির দাম এক টাকা এক মণ হয়ে যায়। এমনও হয়, বিক্রি না হওয়াতে কৃষকরা নিরুপায় হয়ে গরু-ছাগল দিয়ে তা খাইয়ে দেন। সেই শাকসবজি ঢাকা বা মহানগরগুলোতে ৪০ টাকার অধিক কেজি দরে বিক্রি হয়। মধ্যস্বত্বভোগী ও বাজারজাতকরণের দুর্বল কাঠামোর কারণে কৃষকরা এর ফলভোগ করতে পারেন না। ফলে তাদের জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থেকে যায় অধরা। এক কেজি ধান বিক্রি করে কৃষক পাচ্ছেন ১২ দশমিক ৫ টাকা। সেখানে নদীমাতৃক সাগরসমৃদ্ধ পানির প্রাচুর্যের দেশে মাত্র হাফ লিটার পানি বিক্রি করে বড় শিল্পপতিরা পাচ্ছেন ১৫ টাকা!

কিন্তু সবচেয়ে অবাক করা কাণ্ড, মোট জনসংখ্যার ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ কৃষকের এ দেশে ধানের দাম বৃদ্ধি নিয়ে কোথাও তেমন কোনো আলোচনা নেই। উন্মাদনা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা দেশের প্রগতি ও প্রকৃত উন্নয়নের পথে কত বড় প্রতিবন্ধক তা এ দেশ আরো ১০ থেকে ২০ বছর পরে টের পাবে।

এত শক্তিশালী সুশীল সমাজ দেশে। তাদের মানববন্ধন ও সমাবেশে প্রেস ক্লাবের সামনে জ্যাম নিত্যদিনের ঘটনা। অথচ কৃষক ও কৃষির উন্নয়নে দৃশ্যত কোনো কর্মতৎপরতা নেই। যা হোক, সরকার কৃষি উন্নয়ন ও কৃষকের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু প্রকৃত কৃষকরা এসব মহৎ উদ্যোগ থেকে বঞ্চিত। কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনিক লোক ও অসাধু ব্যবসায়ী এ জন্য দায়ী। অনেক দিন থেকে শুনছি, শস্যবীমা চালু করা হবে যা এখনো আলোর মুখ দেখেনি।

দেশের সার্বিক ও টেকসই উন্নয়নে সরকারের পদক্ষেপ এবং জনগণের মানসিকতার পরিবর্তনের কোনো বিকল্প নেই। সামনে আমাদের মতো উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ। আতঙ্কজনক ঘূর্ণিঝড়ের মতো ধেয়ে আসছে ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব’। শিল্পবিপ্লব তথা আধুনিকায়নের পথপরিক্রমা সুফলের পাশাপাশি কুফলও বয়ে এনেছে সভ্যতার জন্য। প্রথম শিল্প বিপ্লবে (১৭৬০-১৮৫০) হস্ত বা পশুচালিত ব্যবস্থার স্থলে বাষ্পীয় যন্ত্র উৎপাদনে আমূল-পরিবর্তনে বয়ে আনে। দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবে বিদ্যুৎশক্তি ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ ঘটেছে। তৃতীয় শিল্পবিপ্লবে ইন্টারনেট, পারমাণবিক শক্তি ও প্রযুক্তির মিশেলে সুপারসনিক গতি পায় মানব সভ্যতা। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে প্রযুক্তির সাথে জৈবসার সম্মিলন ঘটবে। সভ্যতার নিয়ন্ত্রণ নেবে রোবোটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবোট, ন্যানো-টেকনোলজি। এ বিপ্লবে প্রযুক্তির গতি ও বিস্তার কর্মসংস্থানের ওপর বেশি আঘাত হানবে। বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আগাম ফসল হিসেবে ২০২৫ সলের মধ্যে বিশ্বের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষের পরিধেয় বস্ত্র কিংবা চশমার সাথে ইন্টারনেট সংযুক্ত থাকবে, পাওয়া যাবে মানুষের শরীরে স্থাপনযোগ্য মোবাইল ফোন, ৯০ শতাংশ মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করবে, আমেরিকায় ১০ শতাংশ গাড়ি হবে চালকবিহীন, ৩০ শতাংশ করপোরেট প্রতিষ্ঠানের অডিট হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবোট দিয়ে, এমনকি কোম্পানির বোর্ডের একজন পরিচালক হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবোট’।

এ ধরনের আরো বহু অবিশ্বাস্য উদ্ভাবন ও আবিষ্কার বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেবে। প্রযুক্তির এ অভাবনীয় অগ্রগতি, সাফল্য, বিস্তার এবং কর্মসংস্থানের ওপর এর প্রভাব মানুষে মানুষে, দেশের সাথে দেশের বৈষম্যের মাত্রা অনেক বৃদ্ধি করবে। ইতোমধ্যে শিল্পোন্নত দেশগুলো প্রযুক্তির উৎকর্ষে স্বল্পোন্নত তথা উন্নয়নশীল দেশ থেকে অর্থনৈতিকভাবে অনেকখানি এগিয়ে রয়েছে।

এ অবস্থায় চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বিরূপ প্রতিক্রিয়া মোকাবেলায় আমাদের কালক্ষেপণ করার কোনো সুযোগ নেই। বৃত্তিমূলক ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বিশাল অদক্ষ ও স্বল্প দক্ষ কর্মী বাহিনীর দক্ষতা বাড়াতে হবে। অন্যথায় প্রযুক্তির দ্রুতগামী ট্রেনে আমরা চড়তে পারব না। ফলে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আমাদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে; তেমনি মে দিবসের মূল চেতনা বাস্তবায়ন অনেকটা অধরাই থেকে যাবে। মানুষের জীবনযাত্রার আমূল পরিবর্তন এনে দেবে। কোটি কোটি মানুষের কাজ বা চাকরি কেড়ে নিয়ে তাদের করে দিতে পারে স্থায়ী বেকার।

ফলে ঘটে যেতে পারে বেকার মানুষ বনাম রোবোট মহাযুদ্ধ যার ব্যাপকতা বিশ্বযুদ্ধকে হার মানাবে। দেশে দেশে সামাজিক বিশৃঙ্খলা প্রকট আকার ধারণ করবে। এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এমন দুটি খাতের পাশাপাশি আয়ের নতুন খাত সৃষ্টি করা এবং তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাব ইতিবাচক ধারায় প্রবাহিত করা। তা না পারলে অর্থনীতির জন্য অমানিশার অন্ধকার অপেক্ষা করছে। তারপরও আমরা আশাবাদী। তরুণ সমাজকে যদি সরকার যথাযথ প্রশিক্ষিত ও দক্ষ-যোগ্য করে গড়ে তুলতে উদ্যোগ গ্রহণ করে, তবে সামনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা সক্ষম হবো। এ ক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, মাঝে চীন উন্নয়নের গতি বাড়াতে প্রায় ২০ বছর উচ্চতর শিক্ষাকে নিরুৎসাহিত করে কারিগরি শিক্ষাকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিয়েছিল। এর ফল তারা ইতোমধ্যে পেতে শুরু করেছে এবং সেই ধারাবাহিকতায় বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। ২০-৩০ বছর পর হয়তো তারা যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে এক নম্বর অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। বাংলাদেশেও এমন কৌশল অবলম্বন সময়ের দাবি।

কৃষি একটা দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার নিউক্লিয়াস বা প্রাণ। আর কৃষি ব্যবস্থার চালিকাশক্তি কৃষক। কৃষকদের অবমূল্যায়ন বা অবহেলা করে কৃষির উন্নয়ন সম্ভয় নয়। সরকারকে কৃষি বাঁচাতে কৃষকদের চাষাবাদে ভর্তুকি প্রণোদনা দিতে হবে।

কৃষকবান্ধব প্রযুক্তির প্রচলন এবং প্রধান প্রধান খাদ্যশস্যের ওপর উচ্চতর গবেষণা করে অধিক ফলনশীল জাত উদ্ভাবনে সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে। অধিক জনসংখ্যার কারণে জমি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে বিভক্ত হলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ সম্ভব হয় না। তাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে বিভক্ত জমি একত্র করে সমষ্টিগত চাষাবাদ করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। কৃষকদের পণ্য উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করা এবং ঝামেলাহীনভাবে বিক্রির জন্য মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কঠোরহস্তে দমন করতে হবে। সরকারি উদ্যোগে শাকসবজিসহ পচনশীল কৃষিপণ্যের জন্য হিমাগার নির্মাণ করতে হবে। এতে করে কৃষক যেমন ন্যায্যমূল্য পাবেন, তেমনি ভোক্তারা প্রত্যাশিত মূল্যে কৃষিপণ্য কিনতে পারবেন। তা বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্র্ধ্বগতি ও মুদ্রাস্ফীতি রোধে সহায়তা করবে। কৃষকরা যাতে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান, এ জন্য সঠিক মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তাই সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কৃষকদের ন্যায্য দাবি ও চাহিদা পূরণে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। কারণ, ‘কৃষক বাঁচলে বাঁচবে কৃষি। কৃষি বাঁচলে বাঁচবে দেশ।’
লেখক : গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877